[ওড়াকান্দি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি
ওড়াকান্দি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি
ওড়াকান্দি হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি। নিপীড়িত ও অবহেলিত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির দূত আধ্যাত্মিক পুরুষ পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের কারণেই গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি লাখ লাখ মতুয়া ভক্তদের কাছে তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ১২১৮ বঙ্গাব্দে ইংরেজি ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ কাশিয়ানী উপজেলা সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পর থেকে সাফলীডাঙ্গা গ্রাম ধন্য হয়ে ওঠে। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্য নাম হরি ঠাকুর। কিন্তু ভক্তরা তাকে হরিচাঁদ নামেই ডাকতেন। বাবা যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পরে পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রাম বসতি গড়ে তোলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। সেখানে হরিচাঁদ ঠাকুর অলৌকিকত্ব ও লীলার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। পাঠশালা অতিক্রম করে তিনি কয়েক মাস মাত্র স্কুলে গিয়েছিলেন। পরে স্কুল জীবন ভালো লাগেনি তার। এ কারণে স্কুল ত্যাগ করে তিনি মিশে যান সাধারণ মানুষের সঙ্গে। প্রকৃতির আকর্ষণে তিনি রাখাল বালকদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন।
বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তার জীবদ্দশায় ওই এলাকার নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। তখন নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেবের প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার শুরু করেন। তার এই সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মতুয়াবাদ’, আর এই আদর্শে যারা বিশ্বাসী, তাদের বলা হয় ‘মতুয়া’। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া।
হরি নামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন, তিনিই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে, সেই মতুয়া।
১৮৭২ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারিতে ৩৬টি বর্ণের উদ্ভব দেখানো হয়েছিল। তার আগে থেকেই সমাজে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা প্রচলিত ছিল। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম ও মতুয়াবাদ প্রচার করেছিলেন। এই মতুয়া মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে তিনি নীল কুঠিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।
সমাজে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জমিদারের লোকজন মতুয়া মতবাদ প্রচারে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বাধা দিয়ে বর্বর নির্যাতন করেছেন। হরিচাঁদ নিজেও অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তিনি এটি প্রচার করে মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। আর মতুয়াবাদ প্রচারের মাধ্যমে তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংগঠিত করেন।
তাদের বিপদ-আপদে সব সময় তিনি জাগ্রত থাকতেন। আর এভাবে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ব্যাপক আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল। এই আধ্যাত্মিক শক্তির বলে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাছে অবতার হিসেবে খ্যাত। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত মানুষ মুক্তি পেয়েছেন এবং অনেক বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করেছেন।
এছাড়া কুষ্ঠরোগ ও বিপদ-আপদে পড়লে তাদের নাম স্মরণ করলে মুক্তি মিলতো বলে প্রচারিত রয়েছে। এভাবে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামযশ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এভাবে দেশ ও দেশের বাইরে তৈরি হয় অগণিত অনুসারী। তখন থেকে তাদের ভক্ত ও অনুসারীরা ওড়াকান্দি এসে ঠাকুরকে মানত করতেন। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম তিথিতে দেশ-বিদেশিসহ লাখ লাখ মতুয়া এখানে আসেন। রোগমুক্তি ও কামনা-বাসনে পূরণের জন্য স্নান করেন। এর মাধ্যমে ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। এ সময় যার যার সাধ্যমত ঠাকুরের নামে দান করেন।
কোন মন্তব্য নেই
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷