Breaking News

আমরা মূর্তি পুজা করি কেন ? শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ সঠিক ব্যাখ্যা ( পর্ব ১ )

 সনাতন নিউজ২৪. <> ঢাকা বাংলাদেশ 



আমরা কি সঠিক ভাবে এর উত্তর দিতে পারি, আর এজন্য আমরা অন্যের কাছে হিন্দুধর্ম কে হাসির পাত্র বানাই।
অনেকেই সনাতন ধর্মের মূর্তি পূজা নিয়ে প্রশ্ন করে।এ প্রশ্ন যে শুধু অন্য ধর্মের লোকেরা করে তাই নয় বরং অনেক সনাতন ধর্মালম্বীরাও করে।

আজ তাই আপনাদের কে মূর্তি পূজা কি এবং কেন করা হয় তা সনাতন দর্শনের আলোকে তুলে ধরব।

মূর্তি পূজার স্বরূপ জানতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে ঈশ্বর ও দেবতা বলতে সনাতন দর্শনে কি বলা হয়েছে।

ঈশ্বর ও দেবতা

প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নেই, বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ। অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নেই। তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা।আমাদের প্রাচীন ঋষিগণ বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই(নিরাকার ব্রহ্ম)।তাই তিনি অরূপ। তবে তিনি যে কোন রূপ ধারন করতে পারেন কারণ তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী।

আমরা 'ঈশ্বর' সম্পর্কে কিছু শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দেখে নিই -

 ঋকবেদে বলা আছে ঈশ্বর “একমেবাদ্বিতীয়ম” – ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।ঈশ্বর বা ব্রহ্ম(নিরাকার ব্রহ্ম)।ঈশ্বর সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে তিনি “অবাংমনসগোচর” অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা(বাক), মন বা চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, তিনি বাহ্য জগতের অতীত।

১. ছান্দেগ্য উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ২ নম্বর পরিচ্ছেদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-

“একাম এবাদ্বিতীইয়ম।”

অর্থ- “স্রষ্টা মাত্র একজনই দ্বিতীয় কেউ নেই।”

২. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-

“না চস্য কসুজ জানিত না কধিপহ।”

অর্থ- “সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কোন বাবা মা নেই, তাঁর কোন প্রভু নেই,তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই।”

৩. “একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি।” (ঋকবেদ-১/৬৪/৪৬) অর্থাৎ “সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে ডেকে থাকেন।”

৪. যজুবেদের ৩২ নম্বর অধ্যায়ের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-

“ন তস্য প্রতিমা আস্তি”

অর্থ- “সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই।”

৫. যজুবেদের ৪০ নম্বর অধ্যায়ের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-

“সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিরাকার ও পবিত্র।”

৬. “একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি” (ঋকবেদ-১/১১৪/৫) অর্থাৎ “সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।”

৭. “দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত” (ঋকবেদ-১০/৭২/৭) অর্থাৎ “দেবতারও পূর্বে সেই অব্যাক্ত(ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগতে উৎপন্ন লাভ করেছে।”

৮. যজুবেদের ৪০.১ “এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে।যিনি কখনই অন্যায় করেন না অথবা অন্যায় ভাবে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা রাখেন না।”

৯. ঋগবেদ ১০.৪৮.৫ “ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেন। তিনি অপরাজেয় এবং মৃত্যুহীনও তিনি এই জগতের সৃষ্টিকারী।”

১০. যজুর্বেদ সংহিতা -৩২.১১ “ঈশ্বর যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত।”

১১. ঋগবেদ সংহিতা -১০.৪৮.১ “ঈশ্বর যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন।”

১২. “ঈশ্বর সকল ভূতপ্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন।” – শ্রীমদ্ভগবদগীতা-১৮/৬১


ঈশ্বর এক কিন্তু দেবদেবী অনেক। তাহলে দেব দেবী কারা ?

মনে রাখতে হবে দেবদেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণা অর্থাৎ জগতের সব গুনের(Quality) আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুনও কারণ সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর চাইলেই যে কো্নো গুনের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুনের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন। দেব দেবীগন সেই ঈশ্বরের এই সগুনের প্রকাশ।অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুনের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যে কোন রূপে সাকার হতে পারেন। কারণ তিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। যদি আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক।

তাই, ঈশ্বরের শক্তির সগুন রূপ- কালী, নবদুর্গা, কার্তিক ইত্যাদি।

বিদ্যা-সিদ্ধির সগুন রূপ- সরস্বতী, গণেশ ইত্যাদি।

ঐশ্বর্যের সগুন রূপ- লক্ষ্মী, কূবের ইত্যাদি।

মৃত্যুর সগুন রূপ- কালভৈরব, ভূতনাথ, যম ইত্যাদি।

তেমনি ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা (দেব)

যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু (দেব)

আর প্রলয়রূপে শিব (দেব)।

তিনি যখন আলোপ্রদান করেন তখন তিনি- সূর্য ও চন্দ্র।

তিনি আবার পঞ্চ ভূত- ক্ষিতি, অপ, মরুৎ, বোম, তেজ।

এই ভাবে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ হয়।

ঐতরেয় উপনিষদ ১.১ তে বলা আছে-

“সৃস্টির পূর্বে একমাত্র পরমাত্মা ছিল এবং সবকিছু ঐ পরমাত্মার মধ্যে স্থিত ছিল। সেই সময় দৃশ্যমান কিছুই ছিলনা। তখন পরমাত্মা স্বয়ং চিন্তা করলেন, আমি, আমি হইতে এই জগৎ নির্মাণ করব।”



এর জন্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই এক ঈশ্বরের অংশ। আর এই এক-একটি অংশ হল এক-একটি দেবদেবী। যদি আমরা ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের ছবিটি দেখি, তাহলে খুব সহজে এটা বুঝে যাব। শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের যতকটা মস্তক আছে, প্রতিটি মস্তক এক একটি দেবতাকে প্রকাশ করে অর্থাৎ  ঈশ্বরের এক একটি গুনের প্রকাশ করে। এবার প্রশ্ন তাহলে কয়টা মস্তক ছিল?

 অর্জুন এখানে বলেছিলেন শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের কোনো সীমা ছিল না, অর্থ্যাৎ তার শুরু আর শেষ ছিলনা। তিনি অসীম,অনন্ত এটাই হল ঈশ্বরের নির্গুণা হবার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

এজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরই ব্রহ্মা, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই শিব।

তাহলে আমারা এখন বুঝতে পারছি দেবদেবী অনেক হতে পারে কিন্তু ঈশ্বর এক এবং দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ। এখানে ২ টি দেবের উদাহরণ দিচ্ছি ব্যাপারটা ভালো ভাবে বোঝার জন্য-

(১)বিষ্ণু - বিষ্-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ ব্যাপ্তি। অর্থ্যাৎ “সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন যিনি” এক কথাই “সর্ব্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ”। মানে সমগ্র জগৎ বিষ্ণুময়। এখানে প্রশ্ন কে সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন?  উওরঃ ভগবান বা ঈশ্বর। ঋগবেদ সংহিতা -১০.৪৮.১ বলা হয়েছে, “ভগবান যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন”।

(২)শিব - শী-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ শয়ন।অর্থ্যাৎ যিনি সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত। এখানে প্রশ্ন কে সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন?  উওরঃ ভগবান বা ঈশ্বর। যজুর্বেদ সংহিতা -৩২.১১ এ বলা হয়েছে,“ভগবান যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত”।

তাই হিন্দুরা বহু দেবোপাসক(বস্তুত দেবোপাসনা ঈশ্বর উপাসনাই) হতে পারে তবে বহু ঈশ্বরবাদী নন।

এতক্ষন আপনাদেরকে বললাম ঈশ্বর আর দেবতার পার্থক্য। এখন বলব তাহলে আমরা কেন এ সকল দেব দেবীগণের মূর্তি/প্রতিমা পূজা করি।



মূর্তি পূজার রহস্য ?

মানুষের মন স্বভাবতই চঞ্চল।পার্থিব জগতে আমাদের চঞ্চল মন নানা কামনা বাসনা দিয়ে আবদ্ধ। আমরা চাইলেই এই কামনা বাসনা বা কোন কিছু পাবার আকাংক্ষা থেকে মুক্ত হতে পারি না।(ধরুন একজন শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষা জীবনের বাসনা থাকে পরীক্ষায় প্রথম হতে চাই।এ জন্য সে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে।) তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা, স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই সগুন ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপের মাধ্যমে।মনে রাখতে হবে আমরা কখনই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতা কে আমদের সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারব না। বরং সর্বগুণময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুনকেই বুঝতে পারব।আর এ রকম এক একটি গুনকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোন দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারব।আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুনের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গনিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরা। আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই হয়ত আমরা গনিতের সমস্যার উত্তর পেয়ে যাই। অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা কোন কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করি। কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হল যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই কিন্তু অবস্থিতি আছে – যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপতে পারি। আবার ধরুন ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করি এটা পৃথিবী আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলি এটা লন্ডন, এটা ঢাকা এটা জাপান। কিন্তু ঐ গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী?  অথচ ওগুলো দেখেই আমরা পৃথিবী চিনছি।

তেমনি মূর্তির রূপ কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুন সম্পর্কে ধারনা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌছাতে সাহায্য করে। হিন্দু ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাড়িয়ে সত্য উত্তরণই পূজার সার্থকতা। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে।নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী। এজন্য গীতায় বলা আছে, "যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন।তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। কিন্তু সাকারবাদিদের সাকার ভগবানের উপর মনস্থির করা তুলনামূলক ভাবে সহজ"। এই সাকার ভগবানের চাহিদা মেটাই 'মূর্তি/প্রতিমা' গুলো। এছাড়া এই মূর্তি/প্রতিমাগুলি আমাদের পরম ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কার্যকারীতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। 

আরো দেখুন : আমরা মূর্তি পুজা করি কেন ? শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ সঠিক ব্যাখ্যা ( পর্ব ২ )

কোন মন্তব্য নেই

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷